প্রতি বছরই চর এলাকা বন্যায় অক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়। এ বছরও বন্যায় চরের বিস্তীর্ণ এলাকা নিমগ্ন হয়ে আমন ধানের ক্ষতি করেছে। চর এলাকার ভূপ্রাকৃতিক অবস্থান এবং বিশ্বের জলবায়ুর পরিবর্তন, উভয়েই বন্যার মাত্রাকে বাড়িয়ে দিচ্ছে। The Intergovernmental Panel on Climate Change (IPCC)--এর পঞ্চম মূল্যায়ন রিপোর্ট অনুযায়ী গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের বর্তমান মাত্রা কমানো না গেলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা আগামী ২১০০ সালে বর্তমানের চেয়ে প্রায় ৩.৭-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যাবে। এতে গ্রীষ্মকালে উচ্চতাপমাত্রার দিনের পরিমাণ বেড়ে যাবে এবং শীতকালের দিনের পরিমাণ কমে যাবে। ফলে দিন প্রতি বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেড়ে যাবে অথচ বৃষ্টির দিনের সংখ্যা কমে যাবে। অর্থাৎ বর্ষাকালে দিনপ্রতি বৃষ্টিপাতের মাত্রা বেড়ে যায় এবং বছরের অন্য সময়ে বৃষ্টিপাতের দিনের সংখ্যা কমে যাবে। যার ফলে বাংলাদেশে বর্ষাকালে বন্যার প্রকোপ বাড়তেই থাকে এবং চর এলাকা হয় তার প্রধান টার্গেট।
ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, পদ্মা ও মেঘনা এবং এদের প্রায় ৫০০ শাখা-প্রশাখা দিয়ে পানির সঙ্গে প্রতি বছর প্রায় ২.৫ বিলিয়ন টন মাটি কণা প্রবাহিত হয়। নিয়মিত এ পলি ড্রেজিং করা অত্যন্ত ব্যয় সাপেক্ষ, যার সংকুলান করা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত কঠিন। নদীর বুকে এ মাটি কণা জমা হয়েই প্রায় এক মিলিয়ন হেক্টর চরের উৎপত্তি হয়েছে। হিমালয় থেকে প্রবাহিত মাটির মধ্যে থাকে বালু কণা (Sand), পলি কণা (Silt) ও কাদামাটি কণা (Clay)। বালু কণা আকারে বড় ও ভারি বিধায় প্রথমেই দেশের উত্তরাঞ্চলের চরে তা জমা হয়, পলি কণা বালু কণার চেয়ে ছোট ও হালকা কিন্তু কাদা কণার চেয়ে বড় এবং ভারি বিধায় দেশের মধ্য অঞ্চলের চরে জমা হয় এবং পলি কণা সবচেয়ে ছোট ও হালকা বিধায় দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চরে জমা হয়ে থকে। ফলে দেশের উত্তরাঞ্চল ও মধ্য অঞ্চলের চরের পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয়।
ভূপ্রাকৃতিক কারণেই প্রতি বছর চরে বন্যা দেখা দেয়। তবে যে এলাকায় প্রধান নদীর সঙ্গে বেশি সংখ্যক শাখা-প্রশাখা নদী যুক্ত হয়েছে সেসব এলাকায়ই বন্যার প্রকোপ বেশি হয়। প্রতি বছর বন্যা হলেও বন্যার সময়ও এর ব্যাপকতার ওপর নির্ভর করে কৃষকের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ। আবার বন্যার সময় ও এর মাত্রা নির্ভর করে হিমালয়ে বৃষ্টির সময় ও পরিমাণের ওপর। জলবায়ুর পরিবর্তনের ছোঁয়া বাংলাদেশের বন্যার গতি-প্রকৃতির ওপর দৃশ্যমান প্রভাব ফেলছে।
বন্যায় চরের কৃষির ক্ষয়ক্ষতির ধরন : চরে প্রতি বছর বন্যা হবে এটাই স্বাভাবিক। এটা চরের কৃষকের জীবনের অংশ বিশেষ। কিন্তু বন্যার মাত্রা বেশি হলে কিংবা এর স্থায়িত্ব দীর্ঘ হলে কৃষককে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষকের সবচেয়ে অসুবিধা হয় গবাদিপশুর বাসস্থান নিয়ে। গোয়ালঘর ভেঙে যায়, গোখাদ্যের অভাব প্রকট আকার ধারণ করে এবং পশুর অসুখ বিসুখ বেড়ে যায়। দুর্গম এলাকায় চরের অবস্থান হওয়ার কারণে গরু-ছাগল চুরি বা ডাকাতির মাত্রাও বেড়ে যায়। তাই অনেক সময়ই মানুষ এবং পশুকে একই ঘরে বসবাস করতে হয়। সংরক্ষণাগার না থাকায় বন্যায় ফসলের বীজ নষ্ট হয়ে যায়। বর্ষাকালের প্রধান ফসল আমন ধান বিনষ্ট হয়। তবে আমন ধানের ক্ষতির মাত্রা নির্ভর করে বন্যার স্থায়িত্ব, বন্যার পানির গভীরতা, ধানের জাত ও গাছের বৃদ্ধির পর্যায়ের ওপর। চারা রোপণের ২০ দিনের মধ্যে ধানের চারা সম্পূর্ণ ডুবে গেলে এবং বন্যার স্থায়িত্ব যদি দুই সপ্তাহের, তাহলে আমন ধান রক্ষা করা সম্ভব হবে না। কিন্তু যদি কুশি গজানোর মধ্য পর্যায়ে বন্যা দেখা দেয়, তাহলে বন্যার স্থায়িত্ব দুই সপ্তাহের বেশি হলেও কৃষক আশানুরূপ ফলন পাবে।
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ও কৃষির জন্য করণীয় : দেখা গেছে, যে বছর বন্যার প্রকোপ বেশি হয় সে বছর রবি মৌসুমের (শীতকালীন) ফসলের ফলন ভালো হয়। এর কারণ হলো বন্যার মাত্রা বেশি হলে হিমালয় থেকে আসা পলির পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। এসব পলিতে গাছের বিভিন্ন প্রকার খাদ্যোপাদান থাকে। তাছাড়া বর্ষায় যেসব জমির আমন ধান বিনষ্ট হয় সেসব জমিতে কৃষক সঠিক সময়ে অর্থাৎ অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরের প্রথমেই রবিশস্য যেমনÑ গম, ডাল ও তেল জাতীয় ফসল ইত্যাদির চাষ করতে পারে। ফলে ফলনের পরিমাণ হয় আশানুরূপ।
অনেক বছর আগস্ট মাসের পর বড় বন্যার প্রকোপ দেখা দেয় না। এরূপ ক্ষেত্রে আমন ধান নষ্ট হলেও চারার সংস্থান করা গেলে পুনরায় স্বল্পমেয়াদি আমন ধান যেমন- বিইউ ধান-১, ব্রি ধান৫৬, বিনা ধান৭ এর চাষ করা যাবে। কৃষক পর্যায়েও ধানের চারা উৎপাদন করা সম্ভব। এজন্য ভাসমান পদ্ধতি বা দাপোগ পদ্ধতিতে চারা উৎপাদন করা সম্ভব। তবে কোনোভাবেই যেসব জমি থেকে বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহেও সরে না যায়, সেসব জমিতে ওই বছর নতুনভাবে আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। কারণ এতে ফলন মারাত্মকভাবে কমে যাবে এবং ওই জমিতে রবিশস্য সঠিক সময়ে চাষ করা যাবে না। কিন্তু যেসব জমির বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ের আগেই নেমে যাবে, সেসব জমিতে দ্বিতীয়বার চারা রোপণ উঁচু জমির ধানের কুশি উঠিয়ে প্রতি গোছায় ২-৩টি কুশি রোপণ করা যেতে পারে। যদি কুশির বয়স ১০-১২ দিনের মধ্যে হয় তা হলে মূল গোছার তেমন ক্ষতি হবে না। লক্ষ রাখতে হবে যে মূল জমির ধানের যে গোছায় কমপক্ষে ৬-৭টি কুশি আছে সেখান থেকে ২টি কুশি তোলা যেতে পারে। এসব কুশি লাগানো গেলে তা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে নতুন কুশির জন্ম দেবে এবং কৃষক কিছুটা হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে। যদি বন্যার পানি সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পরও স্থায়ী হয় তা হলে এসব জমিতে কোনোক্রমেই আমন ধান লাগানো ঠিক হবে না। বরং অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য গরুর ঘাস হিসেবে মাসকলাই কিংবা পাতা জাতীয় স্বল্পমেয়াদি জাতের সবজি চাষ করা যেতে পারে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত জমি অবশ্যই সঠিক সময়ে অর্থাৎ নভেম্বর মাসের প্রথমেই রবি ফসল যেমনÑ গম, ভুট্টা, আলু, ডালজাতীয় ফসল ইত্যাদি চাষ করার জন্য প্রস্তুত করতে হবে। অন্যদিকে বন্যার পানি সরে যাওয়ার পর গবাদিপশুর রোগবালাই বেড়ে যায়। রোগবালাইয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিশেষ নজর দিতে হবে।
চর এলাকায় এবছর রবি ফসলের বাম্পার ফলন না হলে কৃষকের দুর্ভোগের সীমা থাকবে না। কাজেই এখনই কৃষককে রবি ফসল বিশেষ করে গম, ভুট্টা, আলু ও ডালের উন্নত চাষাবাদের ওপর বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। কৃষককে বীজসহ কৃষি উপকরণ আগাম সরবরাহ করতে হবে। চর এলাকার কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষককে কৃষি উপকরণের ওপর যথেষ্ট পরিমাণ ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে হবে। চরের কৃষির ওপর ভর্তুকি হলো সরকারের প্রকৃত কৃষি বিনিয়োগ। অনেক সময়ই সরকারের কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারা দুর্গম চরে কাজ করতে আগ্রহী হয় না। ফলে নতুন প্রযুক্তি থেকে চরের কৃষক বঞ্চিত হয় বা বিলম্বে তা জানতে পারে। এর মূল কারণ হলো অত্যন্ত নাজুক যাতায়াত ব্যবস্থা। মনে রাখতে হবে যে, চরের কৃষক কৃষিকাজ করতে নিরুৎসাহিত হলে বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য তা হবে এক মারাত্মক হুমকি। কারণ উঁচু ও ভালো কৃষি জমি প্রতি বছর প্রায় ০.৭০ শতাংশ হারে কমে যাচ্ছে। চরকে এজন্যই বলা হয় ‘কৃষির হিডেন ডায়মন্ড’। কারণ প্রায় এক মিলিয়ন চরই হলো ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের খাদ্যের আধার।
যেহেতু চরে প্রতি বছরই বন্যা দেখা দেয় এবং ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা আরও বৃদ্ধির যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে সেহেতু চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষ কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করা উচিত। দেখা যায় দুর্গম চরে আধুনিক কৃষির তথ্যাদি অনেক বিলম্বে পৌঁছে। কুড়িগ্রামের বিস্তীর্ণ চর এলাকায় এখনও সোনালিকা জাতের গম চাষ করা হয় যা কৃষি বিজ্ঞানীরা বহু আগ থেকেই চাষ করার জন্য নিরুৎসাহিত করছেন। অথচ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে বারি গম-২৬ কিংবা ২৮ এরই মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে চাষ হচ্ছে। চরের শস্য নির্ঝঞ্ছাটভাবে চাষ করা যায়। তবে উত্তরাঞ্চল ও পদ্মার চরের মাটিতে বালুর পরিমাণ বেশি থাকায় মাটির পানির ধারণ ক্ষমতা কম হয়। অন্যান্য এলাকার তুলনায় তাই চর এলাকায় বেশি সেচের প্রয়োজন হয়। আবার চরে বিদ্যুতের সুবিধা না থাকায় ডিজেলের মাধ্যমে সেচ পাম্প চালাতে হয়। এতে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। বন্যায় যেহেতু কৃষকের বীজ নষ্ট হয়ে যায়, সেহেতু কেন্দ্রীয়ভাবে কৃষক সংগঠন করে বীজ রক্ষণাগার তৈরি করতে হবে। বন্যার প্রকোপ বেশি হলে কৃষককে রবি ফসলের নির্বিঘœ চাষের জন্য বীজসহ কৃষি উপকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তাছাড়া বন্যার সময় গবাদিপশুর থাকার জন্য উঁচু করে সরকারের তরফ থেকে কেন্দ্রীয় গোয়ালঘর করা যেতে পারে। গবাদিপশুর চিকিৎসার যথাযথ ব্যবস্থা করা না হলে চরের কৃষক উন্নত জাতের গবাদিপশু লালন পালনের জন্য উৎসাহিত হবে না। চরে কেইজ বা খাঁচা/প্যানকালচার পদ্ধতিতে বর্ষাকালে দ্রুতবর্ধনশীল মাছের চাষ করা সম্ভব বলে মাৎস্যবিজ্ঞানীরা মনে করেন। তবে সেজন্য কৃষককে প্রশিক্ষণসহ বিশেষ প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। চরে মাছের পোনা সহজে কৃষক পায় না। সেজন্য সম্মিলিতভাবে চরের কৃষকদের সহযোগিতা করতে হবে। আগামী বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য চরের কৃষি ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে এখনই বাস্তবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
প্রফেসর ড. এম আবদুল করিম*
*কৃষিতত্ত্ব বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর